আয়তনের সুবিশাল এবং সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক এই দেশটি একসময় পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি ছিল।সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্রের বদৌলতে গত শতাব্দীতে পৃথিবীবাসী দেখেছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ এবং ৪ দশক ধরে চলা স্নায়ু যুদ্ধ।কিন্তু কিভাবে পতন হয়েছিল এই সমাজতন্ত্রের দেশের।
১৯১৭ সাল ছিল রাশিয়া রাজনীতির জন্য বেশ ঘটনাবহুল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী Petersburg যা বর্তমানে Saint Petersburg নামে পরিচিত। সেখানে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয় এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতা যুদ্ধ হন ফলে পতন ঘটে রুশ সাম্রাজ্যের এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই রাশিয়ার জনগণ রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটায় এরপর সেখানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি অস্থায়ী সরকার যার নাম দেয়া হয় রুশ অস্থায়ী সরকার বা রাশিয়ান প্রভিশনাল গভর্মেন্ট। এরপরের কয়েক মাস এই অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার শাসন কার্য পরিচালনা করে।
কিন্তু সে বছরেই অক্টোবরে এক পালটা অভ্যত্থান মাধ্যমে ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে বল সেবিকা অস্থায়ী সরকারের পতন ঘটায়। এবং শাসন ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বলসেভিকরা। শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থী লিভারেল এবং সাম্রাজ্যবাদীরা একজোট হয়ে গঠন করে হোয়াইট আর্মি এরপর বলসিভি গ্রেড আর্মি আর সাম্রাজ্যবাদী হোয়াইট আর্মির মধ্যে শুরু হয় রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ।
গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ১৯২২সালের ৩০ ডিসেম্বর আরো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একত্রিত হয়ে গঠন করে ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক বা ইউএসএসআর অথবা সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯২৩ সালের জুন মাসেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং
পরে কমিউনিস্ট মতবাদের বেশ প্রসার ঘটে পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যে রাশিয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেয় আরো কয়েকটি রাষ্ট্র। সময়ের ব্যবধানে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিণত হয় এক বৃহৎ রাষ্ট্রে।
এরপর কমিউনিস্ট মতবাদের ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছিল নবগঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন তবে বিপত্তিটা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ইতালির স্বৈরশাসকের পতনের মধ্য দিয়ে শাসনতন্ত্র হিসেবে পৃথিবী থেকে ফেসিবাদের বিলুপ্তি ঘটে।
ফলে টিকে যাওয়া দুই শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদে প্রতিনিধিত্বকারী যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয়ে যায় স্নায়ু যুদ্ধ।
সামরিক, রাজনৈতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে একে অপরকে টক্কর দিতে থাকে দুই রাষ্ট্র। দুই রাষ্ট্রই পারমাণবিক ক্ষমতাধর হওয়ার কারণে তারা সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারতো না। স্নায়ু যুদ্ধের সময়টাতে তারা ছায়া যুদ্ধ করার মাধ্যমে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। দুই পক্ষেরই বিরোধ চলে প্রায় চার দশক পর্যন্ত।
কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে এসে হঠাৎ দুর্বল হতে শুরু করেছে সোভিয়েত শাসন। এবং অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে মাত্র দেড় থেকে দুই বছরের ব্যবধানে চূড়ান্ত পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। যে সময় কেউ হয়তো ভাবতেও পারিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এত দ্রুত সময়ের মধ্যে হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য একক কোন কারণ কি দায়ী করা যায় না বরং বেশ কয়েকটি সমসাময়িক ঘটনার সংবদ্ধ প্রভাব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ।
১৯৮৫ সালের ১১ই মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা আরোহন করেন মিথাইল গর্ভাচিব। গর্ভাচিব ক্ষমতায় আসার পূর্বে কমিউনিস্ট শাসকদের কঠিন শাসনে জনগণ রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল.
তাদের সীমাহীন দুর্নীতি একনায়ক তন্ত্র কায়েম এবং জনগণের জীবন মানের দিকে নজর না দেওয়ার কারণে কমিউনিস্ট শাসকদের উপর থেকে দিন দিন আস্থা উঠে যেতে শুরু করে সাধারণ জনগণের। গর্ভাচিব তার পাঁচজন কমিউনিস্ট শাসকের থেকে বেশ উদারবন্দী ছিলেন। ফলে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং ১৯৮৬ সালে গ্লাস নসবা স্বচ্ছতা এবং প্যারিস রুইকা নীতি গ্রহণ করেন।
এই নীতি অনুসারে সোভিয়েত নাগরিকরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। কমিউনিস্টদের একনায়কতন্ত্র কাটিয়ে ভিন্ন দল ও মোট চর্চা সুযোগ করে দেয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ এর ফলে প্রায় ৭০ বছর ধরে চলা বন্দী দশা থেকে মুক্তি পান। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ ফিরে পায় তাদের স্বাধীনতা। চীনের মত ক্যাপিটালিজম এবং কমিউনিজমের সংমিশ্রণে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন কে।
গর্বাচেবের নতুন নিয়মে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় যে একাধি পত্র ছিল সেটাও অবসান ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। মূলত ইউনিয়নের সংস্কারের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থার উপর সাধারণ জনগণের বিশ্বাস পুন-স্থাপিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যায়।
নতুন সংস্কারের পর জনগণ মতামতের স্বাধীনতা পেলে তারা হঠাৎ করেই মুক্ত পাখির মতো উড়তে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে চলা কমিউনিস্ট শাসনের বেড়াজাল থেকে একেবারে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে তারা।
উন্নত জীবন ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আসায় রাশিয়ার জনগণের সামনে কমিউনিজম থেকে বেরিয়ে যাবার পথ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে গর্বাচেবের সংস্কার নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হলেও আদতায় ইউনিয়নের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল বাকি দুনিয়া থেকে আলাদা সেখানে ব্যক্তি মালিকানায় কোন সম্পদ থাকত না সকল সম্পদের মালিক হতো রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মালিক হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা নিয়ন্ত্রিত হতো কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারাই।
কারন তারাই ছিল ক্ষমতাধর। এই ব্যাপক ক্ষমতাই কমিউনিস্ট নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতির দিকে ধাবিত করেছিল। সে সময়ের রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে উৎপাদন কাজ সম্পাদিত হতো বলে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণও ছিল বেশি। এমনকি সে সময় অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। পেট্রোলিয়াম থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছেছিল।
৭০ এর দশক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির জন্য স্বর্ণযুগ। সে সময় অর্থনৈতিক শক্তির কারণেও সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ু যুদ্ধে আমেরিকাকে ভীষণভাবে টক্কর দিতে পেরেছিল। ১৯৯০ সালের দিকেও তাদের অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না। আমেরিকার পরেই দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ ছিল তারা। ১৯৯১ সালের হিসেব অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের জিডিপি ছিল ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং গড় আয় ছিল ৮ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার। তবে এত শক্তিশালী অর্থনীতি দেশের জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
তার কারণ ব্লাক মার্কেট বা কালো বাজার কমিউনিস্ট নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
এর মধ্যে আবার স্নায়ু যুদ্ধের ফলেই কারখানাগুলোতে ভোগ্য পণ্যের পরিবর্তে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন বেড়ে যায়। স্নায়ুযুদ্ধে টিকে থাকতে সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এর বিকল্প অবশ্যই ছিল না। উপরোন্ত মার্কিন প্রশাসন ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে জোর দিলে এই প্রতিযোগিতা বাড়তেই থাকে। ৭০ এর দশকের সোভিয়েত ইউনিয়নের কারখানাগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের ৭০ ভাগে ছিল সামরিক সরঞ্জাম ফলে সংকটে পড়ে যায় অভ্যন্তরীণ ভোগ্য পণ্যের চাহিদা।
কমে যায় জীবন যাত্রার মান এছাড়াও স্নায়ুযুদ্ধের ফলে মহাকাশ অভিযানে ব্যাপক অর্থব্যয় করতে হয়। দুই পক্ষকেই মহাকাশ গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ সেসময় ইউনিয়নের অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে বাকি নিয়ম গুলোকে সাহায্য করেছিল। অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের ফলে আমেরিকার সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে যার ফলে রপ্তানি মুখের সোভিয়েত অর্থনীতি বিশাল এক ধাক্কা খায়।
তাদের অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারের সাথে সমন্বয়হীনতা দিন দিন অর্থনীতিকে গভীর খাদের দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
এখানে আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হইয়া আসে বিভিন্ন দেশে চলতে থাকা ছায়া যুদ্ধগুলো। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ সামরিক ব্যয় হয়।
স্নায়ু যুদ্ধের কারণে এসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সোভিয়েত অর্থনীতির জন্য একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মূলত চার দশক ধরে চলার স্নায়ুযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির এক বাক্যরা করে রেখেছিল।
অন্যদিকে গড়বাচ্চায় বেশি শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে দেন এবং নতুন নোট ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। ফলে অবধারিতভাবেই মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। তার উপর আবার ১৯৮৬ সালে তেলের দাম কমে গেলে ব্যাপক সংকটে পড়ে যায়।
এতো বোরো রাষ্ট্র চালানোর জন্য যে অর্থনৈতিক শক্তি প্রয়োজন ছিল তা হারিয়ে ফেলে তারা। অন্যদিকে ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতি ও জনগণের উচ্চ জীবনযাত্রার মান সোভিয়েতবাসীকে কমিউনিজমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। ৯০ দশকের একেবারে শুরুতেই ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় কমিউনিজম ফলস্বরূপ ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার রাস্তা সুগম হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকরা তাদের জালিম একনায়ক নায়ক কমিউনিস্ট সরকারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পোল্যান্ড, রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
এর মধ্যে আবার ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল ভেঙে দিয়ে এক হয়ে যায় দুই জার্মানি। কার্যত জার্মানির একত্রীভূতকরণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বুকে করা আঘাত এরপর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে থাকে।
কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব বিশ্ব রাজনীতির জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এছাড়াও চেনবীর বিস্ফোরণের পর দুর্ঘটনাকে যেভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয় তা সোভিয়েত ইউনিয়নের একনায়ক কমিউনিস্ট সরকারের প্রতি চরম দায়বদ্ধতা সংকট তৈরী করে। যা ইউনিয়ন ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করেছে।

0 Comments